স্টাফ রিপোর্টার : করোনার সময়ে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে লড়াই করছে দেশের পুলিশ বাহিনী। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও নিরাপত্তার বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি নাগরিকদের পাশে থেকে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন এ বাহিনীর সদস্যরা। ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার ও প্রতিবেশীর সুরক্ষায় কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, এমনকি মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ দাফনও করছে পুলিশ। দরিদ্র ও অসহায় মধ্যবিত্তের ঘরে খাবারও পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ। মানবিকতার হাত বাড়িয়ে এ ধরনের কাজ করায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দেশের মানুষের প্রশংসাও কুড়িয়েছেন।
করোনা ভয়ংকর ছোঁয়াচে ভাইরাস জেনেও দায়িত্ববোধ, সেবাব্রত আর মানবিকতাবোধ তাদের কর্মস্থলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে এরই মধ্যে করোনায় মারা গেছেন পুলিশের ৩০ জন সদস্য। গতকাল রবিবার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৯১৪ জন পুলিশ। এরমধ্যে ডিএমপির ২ হাজার ৯২ জন। তবু করোনা মহামারিতে সেবা প্রদানে অনড় পুলিশ। তাদের মনোবল ভাঙেনি। মৃত্যুভয়ে পিছপা না হওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বপালনকারী ১০ জন পুলিশ সদস্য বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দেশের এ ক্রান্তিকালে জনগণের পাশে থাকবে পুলিশ। এটা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। নিজেরা সংক্রমিত হওয়ার ভয়, পরিবার-পরিজনের পিছুটান উপেক্ষা করে মানুষের জন্য কাজ করে চলেছেন পুলিশ সদস্যরা। কোনো কোনো স্থানে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ গ্রহণ তো দূরে থাক জানাজা পড়ানোর জন্যও পরিবারের কেউ ছিল না। সেখানে পুলিশের সদস্যরা জানাজা পড়েছেন, কবর খুঁড়েছেন এবং দাফন করেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে অন্য কারণে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশও এলাকাবাসী বাধা দিচ্ছেন দাফন করতে। পুলিশ সেখানেও মৃত ব্যক্তির পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শনিবারও রাজধানীর মহানগর হাসপাতালে ৫০ ঊর্ধ্ব এক মৃত মহিলাকে রেখে তার পরিবার সবাই চলে যান। পরে পুলিশ করোনায় আক্রান্ত ঐ মহিলার দাফনের ব্যবস্থা করেন। দেশের অপরাধ দমন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা, মামলা তদন্ত, সালিশ করা—এগুলো পুলিশের প্রতিদিনের কাজ। বর্তমানে এসব কাজ ছাড়াও করোনা মোকাবিলায় নিরলসভাবে কাজ করছে পুলিশ। করোনার সর্বোচ্চ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে সবাই যখন নিজ নিজ বাসা বাড়িতে নিরাপদে বসবাস করছেন ঠিক সেই মুহূর্তেই রাজধানীর পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চল, মফস্বল শহর এমনকি বিভাগীয় শহরে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অবিরাম ছোটাছুটি চলছে করোনার চারপাশে, প্রাণঘাতী ভাইরাসের সঙ্গে। তবে এতে বিচলিত নন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ পুলিশ সদস্যরা বরং সহকর্মীদের মৃত্যুশোককে শক্তিতে পরিণত করে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। পাশাপাশি নাগরিকদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। চিকিৎসা সেবা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৫ হাজার ১৩৩ জন পুলিশ। মৃতের হার খুবই কম। মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ।
এদিকে করোনায় তিন জন আনসার সদস্যেরও মৃত্যু হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত ৫৫৫ জন আনসার সদস্য। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৩১৮ জন। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ জানান, পুলিশ বাহিনীর মনোবল ভাঙেনি। কঠিন পরিস্থিতিতেও পিছপা হবে না পুলিশ। তিনি বলেন, ‘আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীর তেজগাঁও ২৫০ শয্যার ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল ভাড়া নেওয়া হয়েছে। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো হয়েছে। সব মিলিয়ে ১ হাজার বেডে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া দেশের প্রতিটি জেলা ও বিভাগে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যারাকে রাখা হচ্ছে। বাসাবাড়ি বা ভাড়া করা হোটেলেও আক্রান্তদের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে যা যা প্রয়োজন তার সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, পুলিশের চিকিৎসা নিয়ে এখন আর কোনো সমস্যা নেই। উন্নতমানের পিপিইসহ সুরক্ষা সামগ্রীও দেওয়া হয়েছে। আর পুলিশের ইমানের জোরও বেশি, মনোবলও বেশি। মনোবল ভাঙবে না, মচকাবে না। কোনো কিছুতেই আমরা পিছু হটব না। পুলিশ অতন্দ্র প্রহরীর মতো সেবা দিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে।’
করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই মাঠ পর্যায়ে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। লকডাউন এলাকায় লোকজনের অহেতুক ঘরের বাইরে আসা নিয়ন্ত্রণ, করোনা আক্রান্ত অলিগলিতে টহল ডিউটি, রাস্তায় জীবাণুনাশক ছিটানো, ত্রাণ বিতরণ, ত্রাণ বিতরণে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা, রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছানোসহ করোনা আক্রান্ত রোগীর দাফনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন পুলিশ সদস্যরা। তাই পুলিশের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানবিক পুলিশের অনন্য উদাহরণ হিসেবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশের বৈচিত্র্যময় ভূমিকাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি, পেশা, লিঙ্গ, সংস্কৃতি, অভিবাসন, অভিগমন ইত্যাদিকে বিবেচনায় না নিয়ে নিরপেক্ষভাবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা করোনা দুর্যোগে জনমুখী দায়িত্ব পালন করছেন।