সাইদ আহমেদ বাবু : করোনা যেন এক অভিশাপ! এর ছোবলে বিশ্বের ৪ লাখের বেশি মানুষ অকালে চলে গেল। আক্রান্ত হয়েছে ৭০ লাখেরও বেশি। বিশ্বজুড়ে মৃতের ও আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। করোনার কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জীবনযাত্রা। থমকে গেছে সভ্যতার চাকা। প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব। করোনা বিপর্যয় আমাদের সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলোও অদৃশ্য এই ভাইরাসের কাছে চরম অসহায় হয়ে পড়েছে। সবাই যেন ভীত-সন্ত্রস্ত। কী হবে, কী হতে পারে? কেউ জানে না সঠিক উত্তর। মানুষের মনে এ-মুহূর্তে ভাইরাসের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর আতঙ্ক।বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশ একত্রিত হয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে। তার বিরুদ্ধে জয়ে পৌঁছনোর জন্য প্রাণপণ লড়াই করছে মানুষ। চিকিৎসকসহ সারাবিশ্বের বিজ্ঞানী ও ওষুধ কোম্পানিগুলো দিন-রাত ব্যয় করছে করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে। এসব যতদিন না আবিষ্কার হচ্ছে, গোটাবিশ্ব পারস্পরিক দূরত্বের প্রতিষেধক নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। এই ভয়, সন্দেহ আর অবিশ্বাস নিয়ে বাঁচা যায়? আজ মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সব একাকার, শুধু বেঁচে আছে মানুষ আর মানবতা।
আর এই করোনাবিরোধী লড়াইয়ে বাংলাদেশের কাণ্ডারির নাম বঙ্গবন্ধু-কন্যা মানবতার মা শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের আশা-ভরসার প্রতীক। করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া নানা পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেছে বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস।
বিশ্বের সব মানুষ এক কাতারে শামিল হয়েছে এই যুদ্ধে। লড়ছে অতি সূক্ষ্ম, ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের বিরুদ্ধে। আসলে এই লড়াইয়ের মাঠে সবাই নেতা, সবাই যোদ্ধা। যার যার জায়গা থেকে, যার যার মতো করে লড়ছে প্রত্যেকে।
করোনা সংকটে তেমনি একজন আত্মবিশ্বাসের সাথে লড়ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। সাফল্য বা ব্যর্থতা যা-ই আসুক, যে অদম্য প্রচেষ্টা সরকার দেখিয়েছে, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে ক্ষমতা শেখ হাসিনা দেখিয়েছে, তা দেশবাসীর চোখে আশার আলো এনে দিয়েছে। আত্মবিশ্বাসী মানুষ নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ্য সম্বন্ধে এমন বিশ্বাস গড়ে তোলে যে জীবনে চলার পথে শত ঝঞ্ঝাট ও বাধা-বিপত্তি এলেও নিজের আদর্শের প্রতি সর্বদা অবিচল থাকেন। যারা জীবনে গঠনমূলক কিছু করতে চান, তাদের সর্বদা আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকতে হবে।
বিশ্বমানবের মনে আশা, সাহস, ঐক্য ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আমরা পরাজিত হব না। এই যারা চিরঞ্জীব কণ্ঠশিল্পীদের কণ্ঠে টিভি চ্যানেল থেকে গুন গুন করে ভেসে আসে গানের কলি : ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না/মরার আগে মরব না ভাই মরব না।’ মনের ভেতরে ঢুকে যায় সেই বাণী। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইতিহাস। কত মহামারি এসেছে পৃথিবীতে, কত বিপর্যয়, কত ভূমিকম্প, কত বন্যা… তবু শেষ হয়ে যায়নি মানব জীবনধারা। সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক হলো মানুষের মন থেকে এই ভয় ও আতঙ্ক দূর করা। সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় নামা উচিত আমাদের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, খেলোয়াড়, চলচ্চিত্র তারকা ও রাজনৈতিক নেতাদের। জানি, অনেক ভুল ও অপরাধ মানুষের। জীবনের অন্তিমলগ্নে সর্বোপরি শেষ বক্তৃতা ‘সভ্যতার সংকটে’-এ মানব সভ্যতার এক বিপন্ন সময়ে প্রবল আশ্বাসের ঘোষণায়- কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন : মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা- বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ বলেন, ‘দুঃখতাপে ব্যথিত চিত্তে নাই-বা দিলে সান্তনা, দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।’ একটু নিরুৎসাহিত করেন যেন, যেন বলতে চান, তোমার নিজের মধ্যে যে শক্তি আছে তাকে জাগিয়ে তোলো, তাতেই হবে। যে ‘বীর’ আর ‘নির্ভয়’ তাকেই যেন শুধু তিনি বলেন, ‘হবে জয়, হবে জয়!’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আশাবাদই আমাদের প্রেরণা দেয়। চলমান বিশ্ব করোনাভাইরাস সংকটে এ কয়েকটি লাইন আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তার এ কবিতায় বিশ্ববাসী নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে, কিন্তু এই আশাবাদের সত্য অর্জনের রাস্তাটি কঠিন। তার জন্য স্রোতের বিরুদ্ধে একটু ঝুঁকি তো নিতেই হবে। মানুষ প্রস্তুত তো? মানুষ মানুষের জন্য (ভূপেন হাজারিকার গান) যুদ্ধের মোকাবিলার এসব অশ্রুসিক্ত, দৃপ্ত উচ্চারণ আজ জোরে, আরও জোরে বাজছে।
আজকের করোনা মোকাবিলায় এ-সময়ে মানুষ একটি নির্দিষ্ট গতিমুখের সন্ধানে অধিক হাতড়ে বেড়াচ্ছে। লকডাউনের সে-সময় শেখ হাসিনার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘একটি মানুষও না খেয়ে মারা যাবে না’। এ আওয়াজ ১৭ কোটি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছে, বেঁচে থাকার নতুন শক্তি দিয়েছে। চূড়ান্ত অস্থির সময়ে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সামনের পথে হাঁটার কিছু দিক-নির্দেশ এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনা জাতির সামনে রেখেছেন, যে কোনো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে মানুষ ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব প্রত্যাশা করে, শেখ হাসিনা সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিত বিচার করলে সামগ্রিক প্রচেষ্টা ছিল অভিনন্দনযোগ্য। তার পরিকল্পনা তৈরির মূলে রয়েছে দেশবাসীর অগাধ আস্থা। শেখ হাসিনা সকল ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য কাজ করছেন। ভক্তের কাছে ভক্তি বড়, জ্ঞানীর কাছে জ্ঞান বড়, আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে বড় জনকল্যাণ, মানুষকে করোনাভাইরাস ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাংলার মানুষের আস্থা ছিল বলেই তার ডাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে সকল মানুষ একতাবদ্ধ হয়েছিল। এজন্যই বাংলার মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মনে রেখেছে।
সারাদেশের মানুষ এ কারণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাবান। জনগণ মনে করছে বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা দেশকে সঠিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সত্যিই রাজনীতির ময়দানে মাঝে মাঝেই বেশ কিছু বর্ণময় রাজনীতিকদের দেখা মেলে, শেখ হাসিনা অবশ্যই তাদের মধ্যে অন্যতম। এ-মুহূর্তে শেখ হাসিনার সহজ করে যতটুকু সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, আওয়ামী লীগের অন্য কেউই পারবেন বলে মনে হয় না। সব সিদ্ধান্ত সঠিক হবে তা বলছি না। তবে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত গত ১০ বছরে তিনি নিয়েছেন, যা অন্য কেউ নেওয়ার সাহস করতেন না।
মানুষের জীবনের মূল্য সবার আগে আর তার অর্থনীতি, শিক্ষা, আইন আদালত সবকিছু জীবন বাঁচানোর স্বার্থে। রাষ্ট্রের আদেশে লকডাউন আমাদের ঘরে আবদ্ধ করে দিয়েছে। প্রকৃতির কী রকম সর্বনাশ আমরা করেছি তা ছবি দেখলেই বোঝা যায়। ভয় হাতে নিয়ে প্রকৃতি যেন আমাদের জানাতে চাইছে সভ্যতা ঠিক পথে চলছে না।
বহু মানুষ এই বিপর্যয়ে তাদের জীবিকা হারিয়ে কর্মহীন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই মানুষদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থাসহ ১ লাখ ১ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্রকল্প গ্রহণ করেছেন দেশের অর্থনীতির চাকা চালু রাখার জন্য। করোনাভাইরাসের দুর্যোগে দেশের সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবে ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। গত ৫ জুন পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় দেড় কোটি পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে সরকার। ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ১ হাজার ৪১৭ মেট্রিক টন। বিতরণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৯৮ মেট্রিক টন। এতে উপকারভোগী পরিবার সংখ্যা ১ কোটি ৪৫ লাখ ৭ হাজার ৯৮৫টি। উপকারভোগী লোকসংখ্যা ৬ কোটি ৪৪ লাখ ৬৭ হাজার ৬৩৩ জন। নগদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১১৬ কোটিরও বেশি টাকা, সাধারণ ত্রাণবাবদ নগদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯১ কোটি ১৩ লাখ ৭২ হাজার ২৬৪ টাকা। বিতরণ করা হয়েছে ৭৬ কোটি ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকা। এতে উপকারভোগী পরিবার সংখ্যা ৮৬ লাখ ৫০ হাজার ৪৪৯ জন। মোট উপকারভোগী লোকসংখ্যা ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৫৭ হাজার ৮১৪ জন। শিশু খাদ্য সহায়ক হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা এবং এ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে ২০ কোটি ৫৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৬৭ টাকা। এতে উপকারভোগী পরিবার সংখ্যা ৬ লাখ ৫০ হাজার ৫০৯টি এবং উপকারভোগী লোকসংখ্যা ১৩ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৯ জন। দেশের ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে মোবাইলে আড়াই হাজার করে টাকা ঈদে পাঠানোর উদ্যোগ নিলেন। এটি একটি ইতিহাস। মানবতার মা শেখ হাসিনা ভুলে যাননি ৭ হাজার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ও এতিম ছাত্রদের। ভুলে যাননি আল্লাহর ঘর মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত আজান ও জামাতে নামাজ চালু রাখতে। করোনাকালীন ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ সবার প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে ঈদের আগে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বেশি মানুষ হলেও, কেউ যেন বঞ্চিত না হয়। মানুষের দুর্ভোগ, অর্থকষ্ট দূর করাটাই লক্ষ্য।
শেখ হাসিনা যেভাবে সংকল্প দৃঢ়তা দেখাচ্ছেন তাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সুদিন আসার অপেক্ষায় বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এই করোনা নৈরাজ্য হতে মুক্তির আশায় বাঙালি শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। এটা আমাদের দায়বদ্ধতা। আমরা যদি দৃঢ়তার সঙ্গে এগোতে পারি, সারাবিশ্বে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আমাদের কথা শুনবে এজন্য আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।
এই সংকটের সময়ে কেহ কেহ নেতিবাচক রাজনৈতিক মনোভাবের পরিচয় দিচ্ছেন। তা না করে দেশে একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করলে করোনামুক্ত বিশ্বে বাংলাদেশ সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, কারণ এই আত্মনির্ভরতা বাঙালি জাতির বৈশিষ্ট্যে রয়েছে। এই ভাবনার মূলস্রোতে একবার ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখা যেতে পারে।
চলার পথে বাধা তো আসবে। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে ‘তরী খানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে/তাই বলে হাল ছেড়ে দিয়ে কান্নাকাটি ধরব না। আমি ভয় করব না।’ এই তো সংকল্প ও বিশ্বাস। দৃঢ় প্রত্যয়বদ্ধ মন আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোয়। সে জন্য এগোতে চায় শ্রম সংগ্রাম সাধনাকে মূলধন করে। নিজের ওপর আস্থা রাখা চাই তোমার পরিচিতি যাই-ই হোক।
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তিনি সাহসী। শত প্রতিকূলতার মাঝেও অবিচল। সংকটে ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সময় তার সাহস আরও বেড়ে যায়। শেখ হাসিনা তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন। দুর্যোগের সময় তার বুদ্ধিমত্তার প্রখরতাও চোখে পড়ে। করোনার বিরুদ্ধে যে লড়াইটা লড়ছেন শেখ হাসিনা, সেটা তার একার লড়াই। সরকারের যথাযথ প্রস্তুতির কারণে এখনও করোনা সংক্রমণের হার ও মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সারাদেশের মানুষ যার ওপর আস্থা রেখেছে, তার ওপর আস্থা তো রাখতেই হবে। জাতির কাণ্ডারি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের নতুন সূর্যোদয় হবেই!