মোজাম্মেল চৌধুরী : সরব আলোচনা চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘুষের টাকা লেনদেন ঘটনা। ৫ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনকালে আটক হন জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের অডিটর কুতুব উদ্দিন। এর পর থেকেই আলোচনায় চলে আসে হিসাব রক্ষণ অফিসের ঘুষ লেনদেনের ঘটনা। মুখ খুলতে শুরু করেন ভূক্তভোগীরা। হিসাব শাখায় ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে সদর থানায় ৫৪ ধারায় একটি মামলা করেছে। এতে সওজের হুমায়ুন কবীর ও আব্দুল হাইকে স্বাক্ষী করা হয়েছে। অবশ্য সওজের এই ৩ নেতাই ঘুষ প্রদান করতে হিসাব রক্ষণ অফিসে যায়। সড়ক ও জনপথের কর্মীদের বকেয়া বেতন বিল পাসের জন্য ৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবী করে বলে তাদের অভিযোগে উল্লেখ করে। বিষয়টি তারা জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইকে অবিহিত করলে গোয়েন্দা জালে আটক হয়। মামলার নথি কুমিল্লার দুদক কার্য্যালয় থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
বাড়তি পারিশ্রমিক (ঘুষ) হিসেবে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে দীর্ঘদিন ধরে ওপেন সিক্রেট ঘুষ লেনদেন চলছে বলে আলোচনায় উঠে এসেছে। ঠিকাদার মমিনুল হক বলেন, স্বচ্ছতার সাথে কাজ করে বিল নিয়ে ট্রেজারী অফিসে যাওয়ার পর সেখানে কর্মরতরা নানা ছলছাতুরীর মাধ্যমে আদায় করে মোটা অংকের অর্থ। লাখে সাড়ে ৪ হাজার টাকা না দিলে বিল পাস করা হয় না। আরেক ঠিকাদার ছগির আহমেদ জানান, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে কলা কৌশল অবলম্বন করে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। অফিসে ফাইল যাবার পর ইন্টারনেটে ধীরগতি, কাজের ভিষন চাপ ও লোকবল সংকটসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে তাদের পার্সেন্টিজ আদায় করা হয়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের শ্রমিক-কর্মচারীদের কাছ থেকে তাদের বকেয়া বিল পরিশোধে পার্সেন্ট ২০ চাওয়া হয়। পরে ৫ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়া হয়। একটি সূত্র জানায়, তাদের ১২ টি বিলের বিপরীতে এখনো অন্তত ৪০/৫০ লাখ টাকা প্রদান বাকী রয়েছে। এই বিল কৌশলে আটকে রেখেছে জেলা হিসাব রক্ষণ অফিস।
২৫ জুন ৫ লাখ ঘুষ গ্রহনের সময় হাতে নাতে আটক হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের অডিটর কুতুব উদ্দিন। এরপর থেকে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসতে থাকে। অবৈধ এসব কাজ কে বৈধ হিসবেই চলছে এ অফিসে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের মাষ্টার রোলে কর্মরত ৬৩ জন কর্মীর চাকুরী স্থায়ী হলে বর্ধিত বেতনে ১ কোটি ৭ লাখ টাকার বিল বকেয়া আসে। এ টাকা পেতে অডিট অফিসের সাথে ৫ লাখ টাকায় চুক্তি করেন হিসাব রক্ষণ অফিসের অডিটর কুতুব উদ্দিন। চুক্তি মোতাবেক প্রথম দফায় ৬৪ লাখ টাকা নিয়ে যায়। বাকী ৪৩ লাখ টাকার বিল করা হয়েছিল। এ সময় টাকা নিতে আসা সওজের কর্মচারীরা চুক্তি অনুযায়ী অডিটর কুতুব উদ্দিনকে ৫ লাখ টাকা দেন। সেদিন লেনদেনের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিসাব রক্ষণ অফিসের অডিটরসহ কুতুবউদ্দিন আটক হন ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টিলিজেন্স (এনএসআই) হাতে।
ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের অডিটরকে সাময়িক বরখাস্তসহ দুই কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। রবিবার হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে আগত তদন্ত টিম ঢাকায় ফিরে গিয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। বদলি করা দুই কর্মকর্তা হল জেলা হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী ও সুপার ইউসুফ নুরুল্লাহ। তদন্ত কমিটির প্রধান ও মহানিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের ডেপুটি কন্ট্রোলার জেনারেল অব একাউন্টস একেএম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, এ ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের অডিটর কুতুব উদ্দিনকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে জেলা প্রশাসক, সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, এবং হিসাবরক্ষণ অফিস সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ সেলিম উদ্দিন জানান, এটি আমাদের এখতিয়ার নয়। ৫৪ ধারায় একটি মামলা হয়েছে। আমরা মামলার নথি দুদক কার্য্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সহ-সভাপতি আবদুন নূর-ঘুষ আদান-প্রদান চিরতরে বন্ধের দাবী জানান। জেলা একাউন্টস এন্ড ফিন্যান্স অফিসার মোহাম্মদ আলী বলেন, অর্থ লেনদেনের বিষয়ে তার কোন ধারণা নেই। তিনি বলেন, আমি এ জেলায় নতুন যোগদান করেছি।
জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পঙ্কজ ভৌমিক জানান, কর্মচারীরা তাদের চাকরী নিয়মিতকরণের জন্য ২০১৫ সালে মামলা করেন। এর প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে তাদের চাকরী রেগুলার হয়। সে হিসাবে তারা বকেয়া বেতন ভাতা প্রাপ্য হন। এখানে কর্মরত ৬৩ জনের জন্য ১ কোটি টাকার ওপরে বরাদ্দ আসলে তা পাস করাতে হিসাব রক্ষণ অফিস থেকে ঘুষের জন্য চাপ দেয়া হয় বলে কর্মচারী নেতারা আমাকে জানান। ১৬ জনের প্রাপ্য ৪৩ লাখ টাকা বিল পেতে ওইদিন ৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে গিয়েছিলেন তারা।