খবর সারাদিন রিপোর্ট : সমানে ভাংচুর ও লুটপাট চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের চরচারতলা গ্রামে। আতঙ্ক ও প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে হাজারো নারী-পুরুষ। এ গ্রামের লতিফ বাড়ি ও মুন্সি বাড়ি গোষ্ঠির মধ্যে ঝগড়া হয় ২২জানুয়ারী রাতে। টেঁটার আঘাতে খুন হন উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম আহবায়ক ও উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফ মুন্সির ভাই জামাল মুন্সি। হত্যার পরদিন থেকে চেয়ারম্যান ও তার লোকজন ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি করে গ্রামে। ঘরের সমস্ত মালামাল লুটপাট করে নেয়ার পর টিনের চাল পর্যন্ত খুলে নেয়া হচ্ছে। পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি। হামলা-ভাঙ্গচুর চলতে থাকলেও মামলা নেয়নি পুলিশ।
সরেজমিনে চরচারতলা গ্রাম পরিদর্শনে গিয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। বৃদ্ধ হালেমা খাতুন জানান, তার স্বামী নেই। ঘরে ৩ প্রতিবন্ধী সন্তান। কোন কারন ছাড়াই লুটপাট করে তার বসত ঘর। ঘরে কোন ঘুমানোর খাট নেই। পানির মটর, সিলিং ফ্যান সবই লুট হয়ে গেছে। রান্নাবান্না করে খাওয়ার মতো কিছুই নেই। শূন্য একটি ঘর দেখিয়ে শুধুই তিনি কাদঁছেন। খন্দকার বাড়ির আলী রাজা খন্দকারের স্ত্রী হালিমা আর ফরিদা বেগমের ৪০বছরের সাজানো সংসারে অবশিষ্ট কিছুই নেই। লুটপাটে শূন্য তার ঘর। আলমারী ভেঙ্গে সোনা-গহনা সব কিছুই নিয়ে গেছে দুর্বৃত্বরা। জানুয়ারী মাসে ৪লাখ টাকা খরচ করে ঘরে টাইলস বসায় নানা সাজসজ্জা করে। সে ঘরে এখন ধ্বংসস্তুপ। খন্দকার বাড়ি ছাড়াও হামলা-লুটপাটের শিকার হয় চরচারতলার অনেক পরিবার। লতিফ বাড়ির সেলিম পারভেজের ডুপ্লেক্স বিলাস বাসভবন দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠবে। শুধু ইট ছাড়া কোন কিছুই নেই। দরজা-জানালা খুলে নিয়ে গেছে। পাশের মসজিদের পাখা ও লুট হয়েছে।
গত প্রায় ৪মাস ধরে সমানে চলছে ঘরবাড়িতে লুটপাট। কোন কোন বাড়িতে অবস্থানকারী মহিলাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। বাড়ি ছাড়ার হুমকী দেয়া হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত লতিফ বাড়ি, খাঁ বাড়ি, খন্দকার বাড়ি ও নাগর বাড়ি বংশের তিন শতাধিক ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটতরাজ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জামাল মুন্সি হত্যা ঘটনায় ২৭জনের নামে মামলা হয়। অথচ ভয় আর আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছে গ্রামের হাজারো নারী-পুরুষ। অত্যাচারের শিকার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ থানায় মামলা দিতে গেলেও ওসি ফিরিয়ে দিয়েছে। ভাঙ্গচুর-লুটপাটের ঘটনায় উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফ মুন্সিকে প্রধান এবং মোমিন মুন্সি প্রকাশ মোমিন ডাকাতসহ ২৫/৩০ জনকে আসামী করে আদালতে ৮টি মামলা হয়েছে। মামলা গুলো পিবিআই ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে আদালত। অভিযোগ উঠেছে উপজেলা চেয়ারম্যান এসব মামলার তদন্তে প্রভাব বিস্তার করছেন। উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান লিমা সুলতানা জানান, তার বাবার বাড়ি চরচারতলায়। চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের সদস্যরা তাকেও রেহায় দেয়নি। ৫ ভাই তার। তাদের সবার ঘর থেকে রাতে রাতে সব মালামাল লুট করে নেয়। ঘরের মহিলাদের পর্যন্ত অত্যাচার করা হয়েছে। তার এক ভাইয়ের ৭০ লাখ টাকা দামের একটি স্টিলের নৌকা লুট করে নেয়। হত্যা ঘটনার ৩ দিন পর নৌকাটি চেয়ারম্যানের ভাই উজ্জল মুন্সি, চাচাতো ভাই আরমান মুন্সি ও ভাতিজা সুজন মুন্সি নৌকাটি নিয়ে যান বলে জানান তিনি। নৌকাটি উদ্ধারে ওসির সহায়তা চাইলে তিনি লিমার সঙ্গে রাগত সুরে কথা বলে হানিফ মুন্সীকে ফোন দেয়ার কথা বলেন। এরপর হানিফ ভাইকে ফোন দেওয়া হলে তিনি বলেন-এই কুত্তার বাচ্চা তুই সেখানে গেছছ কেরে। আবার বেমাছ, তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করতাছে। তুই আ (আয়) আমি এইডা দেখতাছি।’ এরপর অফিসে গিয়ে প্রতিদিনই নৌকার জন্যে তার কাছে কান্নাকাটি করি। ১৭দিনের মাথায় নৌকাটি কেটে বিক্রি করে দেয়া হয়। ফেরীঘাটে আমার ভাইদের দুটি ভাতের হোটেল দখল করে ভাড়া চেয়ারম্যান নিয়ে যাচ্ছেন। তেলের দোকান ছিলো, সেটি লুটপাট করে তাদের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। লতিবাড়ির মানুষের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের লোকজনের দখলে। জমির ফসলও তারাই নিয়ে গেছে। বাজারের ৫/৬টি বিল্ডিং এর ভাড়াটিয়া সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সরজমিনে চরচারতলায় গেলে অনেকে জানান, চেয়ারম্যানের লোকজন জমিতে লাল নিশান উড়িয়ে ঘোষনা দেন সব জমি চেয়ারম্যান হানিফের। এরপর জমির বিভিন্ন ধরনের ফসল নিয়ে যান। আবু শহিদ মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম জানান, কিছু বাড়ি থেকে মালামাল লুট করে নেয়ার আগে চেয়ারম্যান তার অনুগত পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকদের সেখানে নিয়ে আসেন। এমন একটা ভাব বুঝানো হয় যে, মালামালগুলো তারা হত্যা মামলার আসামীদের আত্বীয়-স্বজনের কাছে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। সে সময় ওই সাংবাদিকরা ভিডিও করে। এই আনুষ্ঠানিকতার পরই মালামালগুলো রেখে দিয়ে বিদায় করা হয়। মনোয়ারার ৪ ছেলের বউয়ের সব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে চেয়ারম্যানের লোকজন। নগদ ২০ লাখ টাকা ছাড়াও তার ঘর থেকে ৫০মন ধান-চালসহ অন্যান্য মালামাল লুট হয়েছে। পানি খাওয়ার গ্লাস পর্যন্ত রাখেনি বলে জানান তিনি। শনিবার রাতে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় খন্দকার বাড়ির স্বপ্না বেগমের ঘর। পোড়া ভিটের দিকে চেয়ে কাদঁতে কাঁদতে স্বপ্না বলেন-আমাকে শেষ করে দিয়েছি। এর আগে ঘরের তালা ভেঙ্গে সবকিছু নিয়ে গেছে। ভয়ে তিনি ঘরে থাকতে পারেন না। রাতে ঘরে ইটপাটকেল মেরে ভয় দেখানো হয়। ৪ মাস ধরে অনেক কষ্টে তার দিন কাটছে। গৃহবধু সুমি বলেন,আমরাতো কোন দোষ করিনি। আমাকে লাঠি দিয়ে মারছে। আমার শ্বশুরকে লাথি মেরে খাট থেকে ফেলে দিয়েছে। আমার ননদ গর্ভবতী, তাকেও মেরেছে। এতো অত্যাচার সহ্য করা যায় না। ৫ মাস ধরে মানুষের বাড়িবাড়ি থাকছি আমরা। সরেজমিনে গেলে বৃদ্ধা সাফিয়া বেগম বলেন, কি দোষ আমাদের। দেশে তো আইন-আদালত আছে, বিচার আছে। আমার ২০ কানি ক্ষেত নিয়ে গেছে। আলু ও ইরি ধান কেটে নিয়ে গেছে সব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, অন্ততঃ আড়াইশ গরু লুট হয়েছে গত ৪মাসে। সকল অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফ মুন্সি বলেন, লুটপাটের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তার ভাই হত্যায় জড়িত আসামীদের মালামাল পুলিশ ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে তাদের আত্বীয়-স্বজনের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। থানার অফিসার ইনচার্জ জাবেদ মাহমুদ ঘরবাড়িতে হামলা-ভাঙ্গচুর ও লুটপাট হওয়ার কথা স্বীকার করেন। তার দাবী কেউ তার কাছে মামলা নিয়ে আসেনি। পুলিশ সুপার মোঃ আনিসুর রহমান বলেন, হত্যা এবং বাড়িঘর ভাঙ্গচুর ও লুটপাট দুটোই অপরাধ। এরসঙ্গে কোন জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে ছাড়া হবে না।
শেয়ার করুন