গ্রাম থেকে সায়ানের চাচা রফিক সাহেব বেড়াতে এসেছে তাদের ঢাকা মুহাম্মদপুর বাসায়। পরদিনই তিনি বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। শহরের নিষ্প্রাণ জীবন দুর্বিষহ মনে হতে লাগলো তার। সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। ভাস্তে সায়ানের তাকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে যেতে পারে নি। অবশেষে নিজেই বাসা খোঁজে বের করলেন। কলিং বেলের বোতাম চাপতেই দরজা খুলে দিল রাবিয়ার মা। সাথে সাথেই লম্বা সালাম। সাথে ছিল এক গাল সুন্দর হাসি। কথা বলতে বলতে ভেতরে নিয়ে গেল রফিক সাহেবকে। এরই মধ্যে রফিক সাহেবের সাদা পাঞ্জাবির বেশ কিছু অংশ লাল হয়ে গেছে রাবিয়ার মার পানের পিকে। যখন থেকে সে পান খাওয়া শিখেছে তখন থেকেই ঘুমের সময় ছাড়া তার মুখে পান নেই এ ঘটনা বিরল। ড্রইংরুমে বসেই রফিক সাহেব তার পাঞ্জাবির নতুন ডিজাইন দেখতে পেলেন। একবার পাঞ্জাবির দিকে, আরেক বার রাবিয়ার মার দিকে তাকিয়ে তিনি নিচের দিকে তাকালেন। সেই তাকানোর মর্মার্থ বোঝা মুশকিল। বেশ কয়েক বার এদিক ওদিক তাকিয়ে রফিক সাহেব বাড়ির অন্যদের কথা জিজ্ঞেস করলেন। রাবিয়ার মা এক নিঃশ্বাসে বলতে শুরু করল, “খালুজান আর খালাম্মা অফিসে, ভাইজান ভাসির্টিতে, আপামণি কলেজে।” রফিক সাহেব বললেন, “ফিরবে কখন?” রাবিয়ার মার উত্তর — “খালুজান ফিরে রাত ৯টায়, খালাম্মা ৭টায়, ভাইজান ১০টায়, আপামণি ৬টায়।” উত্তর শুনে রফিক সাহেব হতবাক হয়ে যায়। রাবিয়ার মা তাঁকে আশস্ত করে বলে কোন সমস্যা নেই চাচাজান। আমি আছি না! আপনি গোসল করে আসেন, আমি খাবার রেডি করছি । তারপর রাবিয়ার মা একটু থামল। একগাল হাসি মুখে ঢেলে দিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,”পাঞ্জাবিটা খুলে দেন।ধুইতে হবে। আমার সাথে যে কথা বলে, তার কাপড় আমারই ধুইয়া দিতে হয়।” রফিক সাহেব সামান্য হাসলেন। রাবিয়ার মার হাতে পাঞ্জাবিটা দিয়ে তিনি বাথরুমে ঢুকলেন।
- রাত ১১টা। টেবিলে খাবার সাজানো কিন্তু কেউ খেতে আসছে না। সবাই যার যার রুমে ব্যস্ত। কেউ কম্পিউটারে অফিসের কাজ করছে, কেউ ল্যাপটপে ব্যস্ত, কেউ মোবাইলে ফেসবুকিং করছে, কেউ আবার হালকা পড়াশোনা করছে। গ্রাম থেকে আসা মানুষটার সাথে কথা বলার সময় নেই কারোরই। বাসায় ভাই, ভাস্তে, ভাতিজী, ভাইয়ের বউ সবাই থাকার পরও নিজেকে বেশ নিঃসস্গ লাগছে তাঁর। তার মনে পড়ে গেল ছোট বেলার সেই ঘরোয়া মজার আড্ডার কথা। অবশেষে রফিক সাহেব তার ছোট ভাই শফিক সাহেবের রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলেন। কোন কথা নেই। শফিক সাহেব একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাচ্ছেন। একসময় রফিক সাহেব তার ছোট ভাইয়ের হাত চেপে ধরে বললেন, “” তোরা কি মানুষ নাকি যন্ত্র?”” শফিক সাহেব বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। বললেন, ‘ভাইজান, আপনি গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন তাই অনেক ভালো আছেন। আপনি ঠিকই বলেছেন আমরা আসলে মানুষ নই, যন্ত্র হয়ে গেছি। কেউ কারো সাথে কথা বলার সময় নেই। আত্মীয় স্বজনের বাসায় যাওয়ার সময় নেই। এমনকি পরিবারের সবাই একসাথে বসে খাবারের সময় পর্যন্ত নেই। সত্যি আমরা একেক জন একেকটা মেশিন হয়ে গেছি। রফিক সাহেব বললেন, “কিন্তু কেন এত ব্যস্ততা তোদের?” উপায় নেই ভাইজান। জনজীবনে খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ। সর্ব স্থানে শুধু প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা। ওই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে সব সময় নিজেকে শাণিত রাখতে হয়। আমরা ফিরি রাতে। ছেলেটা ভাসির্টি শেষ করে আইইএলটিসের ক্লাসে যায়, তারপর কম্পিউটার কোর্স, ওটা শেষ করে যায় স্প্যানিশ কোর্সে। মেয়েরও একই অবস্থা! কলেজ শেষ করে চারজন শিক্ষককের বাসায় পড়তে যেতে হয়। ছোট ভাইয়ের এই যান্ত্রিক জীবনের বিবরণ শুনে নির্বাক হয়ে গেলেন গ্রামের স্কুল শিক্ষক রফিক সাহেব। কোনো রকম রাতটা কাটিয়ে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুুতি নিতে লাগলেন তিনি। তার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল এই যান্ত্রিক জীবনের প্রতিযোগিতার কথা মনে হয়ে।